45. ইউসুফ সব বলতে পারে
অনেকদিন ধরেই আমাদের বাড়ির দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা অস্বস্তি কাজ করছিল আম্মুর মনে। পুরোনো দেয়াল, এখনো প্লাস্টার করা হয়নি -চোখে যেনো ঠিক সইছিল না। আগেই সিমেন্ট তুলে রাখা ছিল, কিন্তু তারও তো একটা মেয়াদ আছে! নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে আম্মুর মনে বাড়তে লাগলো তাড়াহুড়ো।
দেওয়ালগুলো ঠিক না করলে কেমন দেখায় বলো তো? সিমেন্টও তো আগে থেকে নিয়ে রাখা। নষ্ট হয়ে যাবে, -বারবার বলতেন আম্মু। আম্মু বলতেন, বাড়িটা তো নিজের -একটু ঠিকঠাক রাখতে হয়।
অবশেষে মিস্ত্রি ঠিক করা হলো -আমাদের পাশের বাড়ির শফি ভাই। সহজ-সরল মানুষ। তিনি এসে কাজ করেও গেলেন। বললেন, মোট তিন-চার দিনের মতো লাগবে পুরো কাজ শেষ করতে।
এভাবেই কাজের শুরু। আর এল সেই দিন -০৩ জুন ২০২৫। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি। ছাইরঙা আকাশ, দিগন্তজোড়া মেঘের চাদর। রাস্তায় পানি জমে ছোটো ছোটো নালা তৈরি হয়েছে। তবু আম্মুর মন অটল -ভেতরের কাজ তো! বৃষ্টিতে কী আসে যায়?
সকাল থেকেই রিমঝিম বৃষ্টি। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। তবুও কাজ থামবে না -আম্মু সকাল সকাল শফি ভাইকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির ভিতরের কাজ, বৃষ্টি কোনো বাধা নয়।
বৃষ্টি মাথায় করেই শফি ভাই এলেন। দেয়াল ঘুরে ঘুরে দেখে বললেন, আজ শুধু দেয়ালে পানি মারি। দেয়ালটা ভিজে নরম হলে কাল থেকে প্লাস্টার করলে টেকসই হবে।
বৃষ্টি একটু কমতেই আমি দোকানের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। আসরের একটু আগের সময়। বাইরে তখনও স্যাঁতসেঁতে বাতাস, ছড়িয়ে পড়া মেঘের চাদর। এমন সময় হটাৎ দোকানে ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে লেখা -আম্মু।
কলটা ধরলাম। ওপাশে কম্পিত গলা। আমি সালাম দিলাম -আসসালামু আলাইকুম। ওপাশ থেকে -ওয়ালাইকুম সালাম বলে সালামের জবাব দেয় আম্মু। তারপর, যেন ঝড়ের আগে নিস্তব্ধতা। ইউসুফ -ইউসুফ মারা গেছে, কারেন্ট ধরেছে!
মুহূর্তেই সময় থমকে গেল। কানে যেন তখনও বাজছিল শফি ভাইয়ের দুপুরের সেই প্রাণখোলা কথা -আমার ইউসুফ এখন সব বলতে পারে।
ইউসুফ হচ্ছে শফি ভাইয়ের একমাত্র ছেলে -দুই বছরের মতো বয়স চলছে। তাদের ছোট্ট সংসারের মায়ার চাদর সেই ইউসুফই। কাজের দিন দুপুরে আমি শফি ভাইয়ের সঙ্গে একসাথে খাবার খেয়েছি। খাওয়ার ফাঁকে শফি ভাই অনেক খুশি হয়ে বলছিলেন -ইউসুফ এখন সবকিছু বলতে পারে, একেবারেই কথা বলা শিখে গেছে। ওর মুখে তখন ছিল বাবার গর্ব আর আনন্দের ঝিলিক।
ভাবতে গিয়ে গলা আটকে আসে। মাত্র দুই বছরের জীবন -সেই সদ্যভাষী কণ্ঠস্বর আজ নীরব! যে বাবার চোখে ছিল গর্ব, মুখে ছিল ছেলের গল্প, সেই মানুষটা আজ কোন শূন্যতায় ডুবে আছে কে জানে!
সে ছিল এক নীরব মায়া, যেন হৃদয়ের কোণে বসে থাকা আলো-আঁধারির এক শিশুরূপ ছায়া। কিছু বলতো না, তবু তার তাকানোয় থাকতো অদ্ভুত এক ভাষাহীন আকর্ষণ। সে কেবল তাকিয়ে থাকতো -দূর থেকে, নিঃশব্দে।
ইউসুফ ছিল এক নীরব মায়া। দূর থেকে তাকিয়ে থাকত, কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে যেত তার দৃষ্টির ভাষায়। সে আম্মুর সাথে খুব মিশতো -তার শিশুসুলভ আবেগে মাখা আন্তরিকতায় অল্প সময়ে হয়ে উঠেছিলো ঘনিষ্ঠ। সে ছিল আম্মুর গল্পসঙ্গী, আম্মুর সাথে সে হাসত, গল্প করত, বায়না করত।
আমার সাথে তার যেন কোন শব্দহীন দূরত্ব ছিল। দেখাশোনাও, বোঝাপড়াও ছিল না বললেই চলে। আমি যেখানেই দাঁড়াতাম, সে তার একটু দূরত্বে এসে দাঁড়াত। কাছে আসত না, তবু ফিরেও যেত না। দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকত -আড় চোখে, মায়ায় ছাওয়া এক অপার্থিব দৃষ্টিতে।
মনে হতো, তার রাজত্ব যেন একটু দূরে। হয়তো দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলেই সে নিজেকে নিরাপদ মনে করত। অথবা, হয়তো জানত -আমি ওর মতো হয়ে উঠতে পারব না, আমার নিজের কাজ শেষে চলে যাবো।
মাত্র দুই বছর বয়সেই ইউসুফ ছিল আমাদের বাড়ির সীমান্তের নীরব এক পাহারাদার। আজ সে নেই। তার আসা-যাওয়ার পথ এখন শুন্যতায় মিলিয়ে গেছে, তার স্মৃতি যেন হৃদয়ের মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে এক অন্তহীন আর্তনাদে। দূর থেকে তাকিয়ে, চোখের কোণ দিয়ে নিঃশব্দে মায়া ছড়িয়ে দেওয়া সেই ছোট্ট প্রতিবেশী -আজ এ-পৃথিবীতে নেই।
তার পায়ের শব্দ নেই, তার চাহনির ধাক্কা নেই, তার উপস্থিতির সে সূক্ষ্ম কম্পনও নেই। তার আসা-যাওয়ার পথ এখন শুধু স্মৃতির ধুলায় ঢাকা।
ইউসুফ এ-র বাবা একাকী, নিঃসঙ্গ, ভেঙে পড়া এক প্রাণ। সেই উঠোনে কেউ আর দৌড়ায় না, হাসে না, লুটিয়ে পড়ে না। বাড়িতে আর কেউ আবদার করে না, আদরে জড়ায় না, কান্না-মেশানো ঘুম ভাঙিয়ে বলে না -বাবা, কোলে নাও। তার বাবা আজ একা। ক্লান্ত হৃদয়ে হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছেন। উঠোনে খেলার শব্দ নেই, বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য কেউ নেই, নাস্তা হাতে ছুটে আসার পথ রুদ্ধ। আবদার, বাহানা, কান্না-মাখা আদরের দৃশ্যপট আজ নিস্তব্ধ।
আহ্ বাবা! কী কঠিন বেঁচে থাকা!
একটি ছোট্ট প্রাণ -যার নীরব উপস্থিতি এক বিশাল শূন্যতার জন্ম দিয়ে গেল। এমন শূন্যতা, যা শুধু হৃদয়েই অনুভব করা যায়, শব্দে প্রকাশ নয়। এই জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা হলো -প্রিয়জন হারানোর পরেও পৃথিবী চলতে থাকে। যার বুক ফেটে কান্না আসে, তার পৃথিবীতে প্রতিটি মুহূর্তে থমকে দাঁড়ায়।
শুধু যারা হারিয়েছে, তারাই বোঝে -একটি শিশুর অনুপস্থিতি কতটা শব্দহীন শব্দে কাঁদায়। এ বেদনার ভাষা নেই, শুধু অনুভব আছে। অন্তরের এক গভীর চুপচাপ কান্নায় ঝুমবৃষ্টি হয় -হৃদয় শহরে।
ইউসুফের আব্বু বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছোট্ট ইউসুফ বাবার পিছু ধরে বাইনা ধরছে, আমিও যাবো, আমিও যাবো। ইউসুফ এর আব্বু একগাল হেসে আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, আজকে নয়, আরেকদিন। চল, আগে একসাথে দোকানে যাই।
বাবা সোহাগ করে কপালে চুমু দিয়ে বলেন, আজকে না বাবা, আরেকদিন। তুমি ভালো করে নাস্তা খেয়ে না-ও। দিনের আলোয় ঘরটা ছিল শান্ত। পাখির ডাক, শিশুর কোলাহল, আর সংসারের ব্যস্ততা একসাথে মিশে ছিল। মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে পাশের বাড়িতে যান। ফিরে এসে মা দেখেন -ঘর নিস্তব্ধ, দরজা যেমন রেখে গিয়েছিলেন। বিছানার কোণে ছোট্ট ইউসুফ, নিঃশ্বাসহীন, নিশ্চল। কে জানত, এ ঘুমের জাগরণ এ-ই ভুবনে হবে না?
“ইউসুফ! ও ইউসুফ! কিন্তু সন্তান জেগে ওঠে না। দেহে প্রাণ নেই। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস বন্ধ। মা দিশেহারা, বুক চাপড়ে কান্না করতে করতে চিৎকার করেন, প্রতিবেশী ছুটে আসে। শুরু হলো এক মায়ের নিরবচ্ছিন্ন শোকযাত্রা। আদরের ইউসুফ, কোথায় গেলি রে? তুই কোথায় গেলি রে! আমি এখন কারে কোলে নিবো? কে এসে আমার গলা জড়িয়ে বলবে ‘মা’? কে আমাকে আদর করে চোখে আঙুল দেবে?
মা কখনো ছেলের জামা বুকে চেপে কান্নায় ভেঙে পড়েন, কখনো তার খেলনা তুলে ধরে প্রশ্ন করেন -তুই কোথায় গেলি রে? কে আমাকে মা বলে ডাকবে? কে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাবে?
মায়ের চোখে এখন সবকিছু ফিকে। সূর্য উঠে, দিন কাটে, রাত নামে -কিন্তু সেই মায়ের কাছে সময় থেমে আছে। কারণ তার হৃদয়ের এক টুকরো মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে।
মা শুধু সন্তানকে হারাননি, হারিয়েছেন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস, জীবনের স্পন্দন। তবুও বারবার তার হৃদয়ে প্রশ্ন ফিরে আসে -না-জানি আমার কলিজার টুকরো কতটা কষ্ট পেয়েছিলো?
বিছানার পাশে ছিল একটি মাল্টিপ্লাগ, বিদ্যুতের সেই যন্ত্র যেন নীরব ঘাতক। খেলতে খেলতে হয়তো ইউসুফের কোমল হাতে স্পর্শ লেগেছিল। আর সেখান থেকেই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়েছিলো ছোট্ট শরীরে।
মা ভাবেন, আমার ইউসুফ হয়তো অনেক ছটফট করেছিল। বাঁচার জন্য চারপাশে তাকিয়েছিল, কারো সাহায্য চেয়েছিল। বড় বড় চোখ করে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, মা আসবে থাকে বিদ্যুৎ যন্ত্রণা থেকে বাঁচাবে। সে চোখের চাহনি এখনো তাড়া করে ইউসুফের আম্মু’কে।
তার নিষ্পাপ মুখ, সহায়হীন দৃষ্টি, অসহ্য যন্ত্রণা -সব যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে গেছে। কে জানে, সেই ছোট্ট প্রাণ ঠিক কতটা চেষ্টা করেছিলো বাঁচতে! হয়তো একবার হাত বাড়িয়ে বলতে চেয়েছিল -আম্মু, আমাকে বাঁচাও!
এই দহন কি নিভবে কোনোদিন? এই শূন্যতা কি পূরণ হবে আখেরাত ছাড়া?
মা শুধু ইউসুফকে হারাননি, হারিয়েছেন নিজের নিঃশ্বাস। সারা দিন ঘুরে ফিরে তার মনে হয়, না’জানি আমার কলিজার টুকরো কতটা কষ্ট পেয়েছিল। বিছানায় ছিল মাল্টিপ্লাগ, বিদ্যুতের প্রবাহে কাঁপে উঠেছিলো তার ছোট্ট দেহ। ছটফট করেছে, বড় বড় চোখে হয়তো চারপাশে তাকিয়েছিল সাহায্যের আশায়। মা বলেন, ওর চোখে আমি যেন শুনতে পাই -আম্মু বাঁচাও!
কিন্তু তখন মা ছিলেন পাশের বাড়িতে কাজে। ফিরে এসে পেয়েছেন নিথর দেহ, আর চিরকালের শূন্যতা। আজও মা সেই চোখ ভুলতে পারেন না। সেই অসহায় চাহনি, না বলা আর্তি -সব মিশে আছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
আজ সবকিছু আছে -খেলার জিনিস, জামা, বালিশ, শুধু ইউসুফ নেই।
আজও মনে পড়ে সেই চাহনি। আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি, আমার ইউসুফ তাকিয়ে আছে -অসহায়ভাবে, নিঃশব্দে বলে যাচ্ছে -আম্মু। কিছুই করতে পারিনি আমি। শুধু এই গলা চেপে ধরা বেদনা নিয়ে বেঁচে আছি। ঘরে তার জামা আছে, খেলনা আছে, বালিশে এখনো তার ঘ্রাণ লেগে আছে -শুধু ইউসুফ নেই।
আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই চাহনি। সেই ব্যাকুল, নীরব আকুতি। যেন বুকের ভেতর ছুরি চালায় -একটি না-পারার বেদনা। তার পর থেকে ঘর আর আগের মতো নেই। ঘরের প্রতিটি দেয়ালে ইউসুফের হাসি, প্রতিটি কোণে তার স্পর্শ। ওর ছোট জামাটা আমি এখনো বুকের কাছে রাখি -তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামাতে পারি না। রাত হলে আমি বিছানায় শুয়ে চাদর আঁকড়ে কথা বলি। আমার ছোট্ট ইউসুফ -মা যে তোর জন্যই স্বপ্ন সাজিয়ে ছিল। তুই না থাকলে তোর মায়ের আকাশের একঝাঁক তাঁরায় স্বপ্নগুলো বৃথা।”
যে সন্তান একদিন মায়ের কোল জুড়ে ছিল, যার প্রতিটি নিশ্বাসে মায়ের হৃদয় স্বস্তি পেত। সেই সন্তানের নিথর দেহ পড়ে থাকে, মা হয়ে যান নিঃশ্বাস গোনা এক প্রাণহীন জীবন।
ঘরটা ঠিকই আছে, সব জিনিসও ঠিকই আছে -শুধু সন্তানের হাসিটা নেই। শুধু "মা" বলে ডাকবার সেই মায়ার কন্ঠস্বর আর নেই!